Soiad Mahedi Blog

সিলেট ভাষা: ইতিহাস, উৎস এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্য

সিলেটি ভাষা (Sylheti) দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ এবং ভারতের আসামের বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরার কিছু অঞ্চলে প্রচলিত এক সমৃদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা। এটি মূলত পূর্বভারতীয় আর্যভাষা পরিবারের অন্তর্গত, কিন্তু ধ্বনিগত, শব্দতাত্ত্বিক ও বাক্যগঠনগত বৈশিষ্ট্যে এটি স্ট্যান্ডার্ড বাংলা (যা আমরা “শুদ্ধ বাংলা” বলি) থেকে আলাদা। অনেক ভাষাবিদ সিলেটিকে বাংলা ভাষার একটি উপভাষা বলেন, আবার অনেকে একে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবেও দাবি করেন।


সিলেট ভাষা: ইতিহাস, উৎস এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্য

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রাচীন উৎস

  • সিলেট অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই অস্ট্রো-এশীয় এবং তিব্বত-বর্মণ জনগোষ্ঠীর প্রভাব ছিল। পরবর্তীতে আর্য জাতিগোষ্ঠী এসে এ অঞ্চলের ভাষাগত কাঠামোতে ইন্দো-আর্য বৈশিষ্ট্য যোগ করে।
  • প্রাচীন বাংলা ভাষার পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে সিলেটি ভাষার উদ্ভব হয় বলে অধিকাংশ ভাষাবিদ মনে করেন। তবে সিলেটি ধীরে ধীরে স্থানীয় ধ্বনি, শব্দ এবং ব্যাকরণে এমন রূপ নিয়েছে, যা একে স্ট্যান্ডার্ড বাংলার থেকে অনেকটাই আলাদা করেছে।

ইসলাম ও আরবি-ফারসি প্রভাব

  • ১৩শ শতকে মুসলিম সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর অনুসারীরা সিলেটে আসেন। তাঁদের আগমন শুধু ধর্মীয় পরিবর্তনই আনেনি, ভাষাতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
  • আরবি ও ফারসি উৎসের অনেক শব্দ সিলেটি শব্দভান্ডারে যুক্ত হয়, যা আজও বহুল ব্যবহৃত।
  • উদাহরণ: দোস্ত (বন্ধু), মেহমান (অতিথি), হিসাব (গণনা)।

সিলেটি ও বাংলা ভাষার মিল

যদিও সিলেটি ভাষা বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড রূপ থেকে আলাদা, তবে এর মূল শিকড় একই ভাষা পরিবারে—ইন্দো-আর্য।
মিল থাকার কারণসমূহ:

  1. مشترك উৎস – উভয় ভাষা প্রাচীন বঙ্গীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত।
  2. ঐতিহাসিক প্রশাসনিক প্রভাব – মধ্যযুগে সিলেট বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত থাকায় ভাষাগত মিল বজায় ছিল।
  3. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ – বাংলা সাহিত্যের প্রভাব সিলেট অঞ্চলেও পৌঁছেছিল।
  4. আদালত ও প্রশাসন – মুঘল আমলে প্রশাসনের ভাষা হিসেবে বাংলার প্রভাব ছিল।

সিলেটি ভাষার বৈশিষ্ট্য

১. ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য

  • বাংলা “শ”, “ষ”, “স” → সিলেটিতে প্রায়শই “হ” বা “স” উচ্চারণ হয়।
    যেমন: “শিশু” → হিহু
  • বাংলা “র” অনেক ক্ষেত্রে “ইয়” বা “ল” ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।
    যেমন: “রাত” → ইয়াত
  • দীর্ঘ স্বরধ্বনির ব্যবহার এবং নাসাল ধ্বনির আধিক্য।

২. শব্দভান্ডার

  • অনেক পুরনো বাংলা শব্দ সিলেটিতে রয়ে গেছে, যা স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় আর নেই।
  • আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশ অনেক বেশি।

৩. বাক্যগঠন

  • সিলেটি বাক্যে প্রায়ই অপসারিত কর্তা (subject omission) দেখা যায়।
    যেমন: “তুমি কোথায় যাচ্ছ?” → কেদে যায়া?

সিলেট ও রাজনৈতিক ইতিহাস

ব্রিটিশ আমল

  • ব্রিটিশরা ১৮৭৪ সালে সিলেটকে বাংলা প্রদেশ থেকে কেটে আসাম প্রদেশে যুক্ত করে।
  • এর মূল কারণ প্রশাসনিক সুবিধা, বিশেষ করে চা-শিল্প নিয়ন্ত্রণ।

বিভাজনের প্রাক্কালে

  • ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের সময় সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণে গণভোট হয়।
  • ভোটের ফলাফলে সিলেটের অধিকাংশ অংশ পাকিস্তানের (পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশ) সাথে যুক্ত হয়, তবে করিমগঞ্জসহ কিছু এলাকা ভারতে থেকে যায়।

বাংলাদেশে সিলেট যুক্ত হওয়ার মূল কারণ

ইতিহাসে বলা হয় যে সিলেটের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

  • এ সিদ্ধান্ত মূলত ধর্মীয় কারণ ভিত্তিক ছিল, ভাষাগত কারণে নয়।
  • তখনকার মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা যুক্তি দেন—একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ (পাকিস্তান) তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখবে।
  • হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামের অধীনে থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবস্থা অনিশ্চিত হতে পারে—এই ভয়ও ছিল বড় কারণ।

📌 অর্থাৎ, সিলেট বাংলা ভাষার সাথে মিল থাকার কারণে বাংলাদেশে যোগ দেয়নি, বরং গণভোটের ফলাফল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেছিল। ভাষা এখানে মূল প্রভাবক ছিল না, যদিও বাংলা ও সিলেটির মিল ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান ছিল।


বর্তমান অবস্থা

  • বর্তমানে সিলেটি ভাষা প্রায় ১.১–১.২ কোটি মানুষের মাতৃভাষা।
  • বাংলাদেশে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলেও সিলেটি ভাষা সিলেট অঞ্চলে শক্তভাবে টিকে আছে।
  • সিলেটি নাগরি লিপি, যা একসময় কোরআন, কবিতা, লোকসাহিত্য লিখতে ব্যবহৃত হতো, আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে, তবে পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা চলছে।


উপসংহার

সিলেটি ভাষা শুধু একটি আঞ্চলিক ভাষা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। এর শিকড় প্রাচীন বঙ্গীয় ভাষায়, তবে এর ধ্বনিগত ও শব্দভান্ডারের স্বাতন্ত্র্য একে অনন্য করেছে।
সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখায়, ভাষা ও সংস্কৃতি যতই মিল থাকুক না কেন, রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপাদান অনেক সময় বেশি প্রভাব ফেলে।
আজকের দিনে সিলেটি ভাষা সংরক্ষণ ও প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করার জন্য স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রচেষ্টা দরকার—যাতে এই ঐতিহ্যবাহী ভাষা হারিয়ে না যায়।

__

এই আর্টিকেলটি লিখেছেন সৈয়দ মেহেদী (Soiad Mahedi)