চার আসমানী কিতাব ও তাদের ভাষা: কুরআন, তাওরাত, জাবুর, ইনজিল
আসমানী কিতাব বা আকাশীয় গ্রন্থ বলতে বোঝায় সেইসব কিতাব, যেগুলো আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী-রসূলদের ওপর ওহি বা অহি আকারে নাযিল করেছেন মানবজাতির পথনির্দেশনার জন্য। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মূলত চারটি আসমানী কিতাবের উল্লেখ পাওয়া যায়:
- তাওরাত – হযরত মূসা (আ.)-এর উপর নাজিলকৃত
- জাবুর – হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর নাজিলকৃত
- ইনজিল – হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর নাজিলকৃত
- কুরআন – হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর নাজিলকৃত
এই কিতাবগুলোর প্রত্যেকটির ভাষা এবং প্রেক্ষাপট আলাদা। নিচে বিস্তারিতভাবে প্রতিটি কিতাব এবং তার ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
চার আসমানী কিতাব ও তাদের ভাষা
📘 কুরআন শরীফ (আরবি ভাষায়)
পবিত্র কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা আল্লাহ তা’আলা সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর নাজিল করেছেন। এটি মানুষের ও জিন জাতির হেদায়াতের জন্য পাঠানো হয়েছে।
➡️ নাজিলের ভাষা: আরবি
➡️ কারণ: নবীজির মাতৃভাষা ছিল আরবি, এবং আরব সমাজের মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে, সে কারণেই কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে।
🕋 আল্লাহ বলেন:
“نَزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ”
অর্থ: নিশ্চয়ই আমি একে আরবি কুরআনরূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।
— সূরা ইবরাহিম: ২
বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ পাওয়া যায়। তবে মূল আরবি ভাষাতেই এটি পড়া ও শোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পূর্ণ ও নির্ভুল অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব।
📗 ইনজিল (সম্ভবত আরামাইক অথবা হিব্রু ভাষায়)
ইনজিল ছিল হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব। খ্রিস্টানদের বর্তমান “বাইবেল” গ্রন্থটি বহু ভাষায় পুনঃরচনা ও অনুবাদের মাধ্যমে গঠিত, যার মধ্যে 'নতুন নিয়ম' অংশটি ইনজিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
➡️ নাজিলের ভাষা: সরাসরি বলা না গেলেও, ঐতিহাসিক ও ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এটি আরামাইক (Aramaic) বা হিব্রু ভাষায় নাজিল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
➡️ কারণ: ঈসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের নবী। বনি ইসরাইলদের প্রাচীন ভাষা ছিল হিব্রু, এবং তখন ফিলিস্তিন অঞ্চলে আরামাইকও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।
📖 কুরআন উল্লেখ:
“আমি ঈসা ইবনে মারিয়মের পেছনে তাদের (নবীদের) পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছি, এবং আমি তাঁহাকে ইনজিল দিয়াছি...”
— সূরা মায়েদা: ৪৬
বর্তমানে ইনজিলের মূল ভাষায় থাকা কোনো স্বতন্ত্র কপি নেই, বরং গ্রীক ও ল্যাটিন অনুবাদ এবং পরবর্তীতে ইংরেজিতে রূপান্তরিত বাইবেলই ইনজিলের পরিবর্তিত রূপ হিসেবে প্রচলিত।
📙 জাবুর (সম্ভবত হিব্রু ভাষায়)
জাবুর কিতাবটি দাওদ (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। এটি গীতসঙ্গীত (Psalms) আকারে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
➡️ নাজিলের ভাষা: হিব্রু ভাষায় নাজিল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
➡️ কারণ: দাউদ (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের নবী, যাদের মাতৃভাষা ছিল হিব্রু।
☪️ কুরআনে বলা হয়েছে:
“...এবং আমি দাউদকে দিয়েছি ‘জাবুর’।”
— সূরা নিসা: ১৬৩
এছাড়াও কুরআনে বলা হয়েছে যে আল্লাহ তাঁর রাসূলদের তাদের নিজ নিজ জাতির ভাষায় পাঠাতেন:
❝আমি প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি, যেন সে তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।❞
— সূরা ইবরাহিম: ৪
📒 তাওরাত (হিব্রু ভাষায়)
তাওরাত ছিল হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ। এই কিতাবে ছিল ইহুদিদের জন্য পথনির্দেশনা ও আলোর দিশা।
➡️ নাজিলের ভাষা: হিব্রু
➡️ কারণ: হযরত মূসা (আ.)-এর মাতৃভাষাও ছিল হিব্রু, এবং ইহুদি জাতি সেই ভাষা ব্যবহার করত।
📜 কুরআনে বলা হয়েছে:
“আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি, যাতে আছে পথনির্দেশনা ও আলো।”
— সূরা মায়েদা: ৪৪
বর্তমানে হিব্রু ভাষায় সংরক্ষিত তাওরাতের কিছু অংশ পাওয়া গেলেও তা আসল তাওরাত নয় বলে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বাস করা হয়, বরং ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য মিশ্রিত একটি রূপান্তরিত গ্রন্থ।
🔍 উপসংহার
চারটি প্রধান আসমানী কিতাব ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসের অংশ। এসব কিতাবের প্রকৃত ভাষা ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা জানার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর পথনির্দেশনা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে ধারণা লাভ করতে পারি।
কিতাব | নবী | ভাষা | বর্তমান অবস্থা |
---|---|---|---|
কুরআন | মুহাম্মদ (সাঃ) | আরবি | অক্ষত ও সংরক্ষিত |
ইনজিল | ঈসা (আ.) | আরামাইক/হিব্রু (সম্ভবত) | পরিবর্তিত বাইবেল |
জাবুর | দাউদ (আ.) | হিব্রু (সম্ভবত) | আংশিক রূপে গীতসঙ্গীত |
তাওরাত | মূসা (আ.) | হিব্রু | আংশিক সংরক্ষিত |
✍️ শেষ কথা
এই আলোচনা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র কুরআন, ইসলামী ইতিহাস, এবং ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহের ভিত্তিতে তৈরি। যদি কোনো তথ্য আপনার জানা মতে ভুল বা অসম্পূর্ণ হয়, আপনি মতামত বা সংশোধনী জানিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
আপনার জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হোক—এই প্রার্থনায় আজকের এই লেখা এখানেই শেষ করছি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন। আমিন।
📢 এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে—
🔁 শেয়ার করুন, ❤️ লাইক করুন এবং ✍️ কমেন্ট করে জানিয়ে দিন আপনার মতামত।
Blog Writer: Soiad Mahedi